
অনলাইন টেক্স,
বিদেশী মিশনে ঐতিহাসিক পতাকা উত্তোলন দিবস আজ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৮ এপ্রিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় দিন। ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলী ৬৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সদলবলে পাকিস্তানের আনুগত্য ত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা “মুজিব নগর” সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্য প্রদর্শন করেন। সেদিন ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার এম হোসেন আলী শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে মুহুর্মুহু জয় বাংলা ধ্বনি আর বিপুল করতালির মধ্যে পাকিস্তানী দূতাবাস ভবনের শীর্ষে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেদিন ছিল রোববার। সময় ছিল বেলা ১২ টা ৪১ মিনিট। তারপর তিনি পাকিস্তান দূতাবাসের নাম বদলে তথায় ‘বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন” এর নাম ফলক উন্মোচন করেন। নবগঠিত বাংলাদেশ কূটনৈতীক মিশনের কেন্দ্রীয় হল ঘর থেকে জিন্নাহর ছবি সরিয়ে ফেলা হল। সঙ্গে সঙ্গে মহম্মদ ইকবালের ছবিও। সেখানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ও কবি নজরুল ইসলামের ছবি টাঙানো হল। এরপর তিনি তাঁর দীর্ঘ ২২ বছর কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করার পর কেন পাকিস্তানের আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন, তার ব্যাখ্যা দিতে একটি বিবৃতি পাঠ করেন। চার পৃষ্ঠার এই বিবৃতিতে তিনি পাকিস্তানীদের বাঙালীদের প্রতি স্বভাবজাত ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং শোষণ-বঞ্চণার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, এই প্রথম একটি পাক দূতাবাস ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সরকারীভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ঘোষণা করল। জানিয়ে দিল, এটা আর পাকিস্তানী দূতাবাস নয়। প্রাক্তন ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলী বললেন, এই হল বাংলাদেশ সরকারের দূতাবাস, এই হল আমাদের একমাত্র পরিচয়। আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় অন্য কোন পরিচয় আমাদের রইল না।
উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীন হলে এম হোসেন আলী উক্ত পতাকাটি ৩২নং ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তাঁর হাতে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু সানন্দে তা গ্রহন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে পতাকাটি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য জাতীয় জাদুঘরে দান করেন। সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যখচিত এবং তার মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র লাগানো এ পতাকাটির পরিমাপ ২৬৪X২০৭ সে:মি:।এম হোসেন আলীর সহধর্মীনি বেগম ফয়জুন্নেছা আলী, কন্যা জলি আলী ও ইয়াসমিন আলীর হাতে সেলাই করা এ পতাকাটি পলিথিনের আবরণ দিয়ে জাতীয় জাদুঘরের তৃতীয় তলায় মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস নামে একটি নতুন গ্যালারীতে দর্শনার্থীদের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
১৯৭১সালের ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে উত্তোলিত পতাকাটি হারিয়ে গেছে। তাই এ পতাকাটি মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য স্মারক হিসেবে বিবেচিত। এ মহামূল্যবান নিদর্শনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালী কূটনীতিকদের হৃদয় নিংড়ানো দেশপ্রেম ও সাহসিকতা। নিদর্শনটি ত্যাগ ও চির প্রেরণার উৎস।
‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইয়ের ১২১ পৃষ্ঠায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেছেন-মুজিবনগর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন ১৭ এপ্রিল। ১৮ এপ্রিল কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী সদলবলে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। এর ফলে বাংলাদেশ সরকার একটি তৈরী সচিবালয় পেয়ে যায়। প্রশাসনিক কর্ম নির্বাহের দিক থেকে এর মূল্য সেদিন ছিল সীমাহীন। কিন্তু তার চেয়ে বড় এ ধরনের সংগ্রামে উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং প্রেরণা। এই দৃপ্ত পদক্ষেপ সর্বত্র বাঙালীর মনে সীমাহীন প্রাণ শক্তির সঞ্চার করে।এম হোসেন আলী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমী সরকারী কর্মচারী এবং অভিজ্ঞ কূটনীতিবিদ। তাঁর অন্তরের তীব্র অনুভতি, দেশপ্রেম, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং সাহসিকতা তাকে এরূপ একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর এই অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর উৎসাহে তাঁর সহকর্মীগণও সানন্দে এবং সাগ্রহে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। তাদের প্রত্যেকের কাছে দেশবাসী চিরঋণী হয়ে থাকবে। তাঁরা এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়াতে আন্দোলনে শুধু কর্ম নৈপুণ্যই যুক্ত হয়নি, বন্যার মত উৎসাহের প্লাবন এসে সকল বাঙালীকে কর্মপ্রবাহে ধাবিত করেছে।২৬ শে এপ্রিল লন্ডন টাইমস্ পত্রিকায় হোসেন আলীর দেওয়া একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ায় তাঁর দূতাবাসের সকল বাঙালী ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন এবং তাঁরা সকলেই দিবারাত্র পরিশ্রম করছেন। এই খবর প্রকাশিত হবার পর থেকে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে বিশ্ববাসীর যোগাযোগ স্থাপনের পথ সুগম হয়। সেই দিক থেকেও এটি নিঃসন্দেহে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এম হোসেন আলীকে “স্বাধীনতা পদক” প্রদান করেন। ২০১১ সালের ১৮ই এপ্রিল বর্তমান সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দিপু মনি একাত্তরের কূটনৈতীক ফ্রন্টে নেতৃত্ব প্রদানকারী এম হোসেন আলীকে মরোণোত্তর “সম্মাননা ক্রেস্ট” প্রদান করেন। ডাঃ দিপু মনি ঘোষণা করেন এখন থেকে প্রতি বছর ১৮ এপ্রিল “পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিবস” হিসেবে উদ্যাপন করা হবে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ এপ্রিল ২০১৪ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত “বিদেশে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস” শীর্ষক আলোচনা সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঘোষণা দেন যে, প্রতিবছর নিয়মিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং বিদেশে বাংলাদেশের সব দূতাবাসে এই দিবস পালন করা হবে।
